৫.৬. ডিমান্ড এগ্রিগেশন, সবচেয়ে বড় ক্রেতা কে?
ফিরে আসি ইন্টারনেটের দাম কমানোর গল্প নিয়ে। যেকোনো দেশের ব্রডব্যান্ডের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে সরকার নিজে। যারা বুঝতে পেরেছে আগে, তারা আজ উঠে গেছে ওপরে। সরকারের হাজারো অফিস, স্কুল, কলেজ আর হাসপাতাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুরদুরান্তে। ওখানের ইন্টারনেটের সংযোগ দেবে কে? কমদামে? ধরুন, আমি ডোমারের একটা স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে আছি। আমার স্কুলে দরকার পাঁচশো বারোর (কেবিপিএস) একটা সংযোগ। ওই একটা সংযোগের জন্য বিজনেস কেস হবে না কিন্তু কোন প্রোভাইডারের। তাও আবার মাত্র পাঁচশো বারো! ওটা ওখানে নিতে যে খরচ – সেটাতে অল্প টাকা যোগ করলে সংযুক্ত করা যাবে পুরো ডোমারের সব সরকারী অফিসগুলোকে।
ফিরে আসি ওই স্কুলের গল্পে। ওই একটা সংযোগ হলেও তার যা দাম হবে সেটা দিতে পারবে না সরকার। আমার স্কুলের ইন্টারনেটের বিলটা দেবে হয়তোবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেটা পাস করাতেও ওই প্রোভাইডারের যে সময় ক্ষেপন হবে তাতে রাজি হবে না সে পরের মাস থেকে। মনে করুন আমি সরকার। প্রথমেই তৈরী করবো একটা ব্রডব্যান্ড কমিশন। চার পাঁচ জনের একটা অফিস। যার জায়গা হবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে। ওই অফিসের পেটে বসে সব মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইবো কার দরকার কতো ব্যান্ডউইডথ। দরকার কি কাজে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হিসেব দেবে তার সব রিজিওনাল অফিস আর হাসপাতালগুলোর ইন্টারনেটের চাহিদা। ভিডিও কনফারেন্স সহ। জেলা ভিত্তিক।
ধরুন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়ত্তে দুরদুরান্তের স্কুলসহ পুরো ব্যান্ডউইডথের হিসেব পাওয়া গেল পাঁচ গিগাবিট/সেকেন্ডের। আবার, জনপ্রশাসন থেকে ডিসি অফিস ধরে সবার চাহিদা পাওয়া গেল আরো তিন গিগাবিট/সেকেন্ডের। এভাবে পুরো বাংলাদেশের সরকারী সব অফিস, পুলিশ স্টেশন, স্কুল কলেজ, হাসপাতালের চাহিদা পাওয়া গেলো পঞ্চাশ গিগাবিট/সেকেন্ডের। হিসেব নিলাম সম্ভাব্য কোথায় কোথায় সংযোগটা লাগবে সেটা সহ। ব্রডব্যান্ড কমিশনের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসলাম আমি। এই পঞ্চাশ গিগাবিট/সেকেন্ডের মধ্যে তিরিশই হচ্ছে ভেতরে ব্যান্ডউইডথ। মানে সরকারী সার্ভারগুলো তো দেশের ভেতরে। নাকি তাও নেই? যুক্ত করে দিলাম দেশের ভেতরের ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জে। তিরিশ গিগাবিট/সেকেন্ড গতি কিনবো না আর। তারমানে কিনতে হচ্ছে মাত্র বিশ গিগাবিট/সেকেন্ড। আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ হিসেবে। সরকারের কতো দরকার তার একটা ‘এগ্রিগেটেড’ ডিমান্ড চলে আসলো আমার হাতে। গুগল আর ফেইসবুকের কিছু প্রাইভেট ব্যান্ডউইডথ চাইলে সেটা নেমে আসবে দশ গিগাবিট/সেকেন্ডে। সরু করে তাকালেন মনে হচ্ছে? আচ্ছা, বাদ দিলাম আজ।
বিজ্ঞাপন দেয়া হলো ওয়েবসাইট আর পত্রিকায়। বিশ গিগাবিট/সেকেন্ডের কতো ব্যান্ডউইডথ দরকার – দেশের কোথায় কোথায়, সেটার হিসেব সহ। এক্সেল টেবিল আকারে দেয়া হলে দেখা যাবে ওই ডোমারের পুরো ‘এগ্রিগেটেড’ ব্যান্ডউইডথ দরকার হচ্ছে প্রায় পাঁচশো এমবিপিএস! আর ওই পাঁচশো এমবিপিএস ওখানে নিতে আরো উপজেলা হয়ে যাবার সময় ওই একই পরিমানের মতো ব্যান্ডউইডথ প্রতি উপজেলায় নামিয়ে যেতে যেতে তার বিজনেস কেস উঠে যাবে অনেক আগেই। সেখান থেকে পাঁচশো বারো কেবিপিএস নেমে যাবে স্কুলে। আশেপাশের অনেকগুলো সরকারী স্থাপনা নিয়ে। পানির দামে।
ভলিউমের খেলা। আন্তর্জাতিক বাজারে একটা ভলিউমের ওপর বেশি মাত্রায় ব্যান্ডউইডথ মানে ‘আইপি ট্রানজিট’ কিনলে সেটার দাম হয়ে যায় পানির মতো। কে কতো দিয়ে কিনছে সেটা নিয়ে গবেষণা করতাম বিটিআরসিতে বসে। একটা আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাতে যা খরচ পড়তো সেটাকে ভাগ করেছিলাম ষোলটা কস্ট কম্পোনেন্টে। হ্যা, ষোলটা। দুঃখজনক হলেও সত্যি এর মধ্যে লোকাল ব্যাকহল মানে দেশের ভেতরের ট্রান্সমিশন খরচটা সবচেয়ে বেশি।
বিজ্ঞাপনের টেন্ডারের উত্তরে বিশাল সাড়া পড়বে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক অপারেটরদের পক্ষ থেকে। লাস্ট মাইল মানে শেষ সংযোগটা দেবার জন্য হুড়াহুড়ি পড়ে যাবে আইএসপি আর মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে। যেখানে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক অপারেটরদের নেটওয়ার্ক নেই – তবে যাদের নেটওয়ার্ক আছে তাদের সাথে ‘মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ করে নিয়ে টেন্ডারে আসবেন তারা। সরকার টাকা দেবে একটা জায়গা থেকে। ওএসএস, ওয়ান স্টপ শপ! আগের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়। বিল পাশ করাতে হবে না প্রোভাইডারদের – নিজের গাটের পয়সা খরচ করে।
Last updated
Was this helpful?