৫.৯ সাগরের নিচে যাবেন নাকি একবার?
১৪.
মূল গল্পে আসি আজ। হিসেবে দেখা গেছে দেশে বেশি সাবমেরিন কেবল আসলে কমে আসে ইন্টারনেটের দাম। একটার বেশি হলেই ওটাতে আর চাইলেও ইনভেস্ট করতে পারে না সরকার। ফলে চলে আসে প্রাইভেট সেক্টর। তখনি শুরু হয় দক্ষতার খেলা। জমে ওঠে প্রতিযোগিতা। একটা থাকলে সেটার নিয়ন্ত্রণ থেকে যায় সরকারের কাছে। ফলে, ওপেন এক্সেস যে ব্যাপারটার কথা বলছি বারে বারে, সেটা ব্যাহত হয় সরকারগুলোর না জানার কারণে। পয়সা ঢেলেছে সরকার – ব্যবহার করবে সরকার, এই মনোভাবটা যতো সমস্যার মূলে। সরকার ঢেলেছে পয়সা – জনগনের পয়সা, জনগনের সুবিধার কারণে। ওখানে এক্সেস থাকবে সবার সমান, সরকারী না বেসরকারী কোম্পানি - সেটা দেখার কথা নয় ‘সুবিধা প্রদানকারী’ কোম্পানিটার।
১৫.
ওপেন এক্সেস নেটওয়ার্ক মানে কেবল প্রোভাইডার ‘হরাইজন্টাল ভার্টিকেলে’ মানে অনুভূমিক নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচারে আলাদা করে ফেলবে তার নেটওয়ার্ককে - অন্যান্য সার্ভিস ডেলিভারি থেকে। ওর ব্যবসা নেটওয়ার্কের হোলসেল, রিটেল নয়। রেগুলেটর এই ধরনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানিকে ভুলেও তাকাতেই দেয় না ‘রিটেল লেভেলে’ ব্যবসার দিকে। যতোই সরকারী কোম্পানি হোক, বাজার নষ্ট করার অধিকার দেয়নি তাকে দেশ। ওপেন এক্সেসের আরেকটা অর্থ হচ্ছে সরকারী আর বেসরকারী কোম্পানি যাই হোক না সবাইকে এক্সেস দিতে হবে তার নেটওয়ার্ক রিসোর্সে। একই শর্তে। সরকারী কেবল হলে পুরোটাই সরকারী নিয়ন্ত্রনে থাকতে হবে সেটা বলা নেই কোথাও। সরকারী নিয়ন্ত্রণে থাকলে হোলসেল প্রাইসটা বেড়ে যায় এমনিতেই। বিশেষ করে অন্যান্য বেসরকারী অপারেটরদের জন্য।
১৬.
‘এসএমপি’, ‘সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার’ নিয়ে কথা হয়েছে আগেই। আন্তর্জাতিক হোলসেল বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করলে সেটাকে ঠিক করার টুল আছে রেগুলেটরের হাতেই। সাবমেরিন কেবল অপারেটরকে ‘মার্কেট পাওয়ার’ হিসেবে ঘোষণা দিলে ওই অপারেটর পড়ে যাবে অনেক বাধ্যবাধকতায়। তার ক্যাপাসিটিতে কস্ট বেসড এক্সেস মানে মুনাফা নয়, প্রোডাকশন কস্টে বেসরকারী অপারেটরকে দিতে বাধ্য সে। শুধুমাত্র সরকারী টেলিকম কোম্পানি পাবে এক্সেস – এটা বলার সুযোগ নেই ‘এসএমপি’ হলে। ল্যান্ডিং স্টেশনে ‘প্রবেশাধিকার’ পাবে দেশের সব অপারেটর। একই শর্তে। এক দামে। এক কো-লোকেশন চুক্তিতে।
১৭.
সাবমেরিন কেবলের মালিক কারা? তাদের ওপর নির্ভর করছে এই কেবলের ফিনান্সিং। টাকাটা ঢালছে তারাই। তাই বলে জানবো না কেবলের মালিকানা অথবা তাদের কাজের ধারা? ইন্টারনেটের দাম কমানো নিয়ে আলাপটাও বৃথা যাবে তাহলে। পুরো পৃথিবীকে যুক্ত করছে যারা – তাদের স্ট্রাকচারের ধারণা পাল্টে দেবে ইন্টারনেটকে নিয়ে। হচ্ছে কি আর কি হলে ভালো হতো সেটা নিয়েও আলাপ হবে আপনাদের সাথে। প্রথম দিকের সাবমেরিন কেবল নিয়ে ছোট ছোট ইনভেস্টমেন্ট করেছিলো দেশগুলোর সরকারী কোম্পানি। টেলিযোগাযোগ ‘লিবারাইজেশন’ মানে উদারীকরনের আগের ঘটনা এটা।
১৮.
মনোপলিস্টিক এনভায়রনমেন্টে প্রতিযোগিতা না থাকায় নিজ নিজ দেশের ভেতরের অংশটুকুর পুরো ক্যাপাসিটির ওপর ছড়ি ঘোরাতো তারা। দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংযোগ দেখার বিভাগটাই চুক্তি করতো বাকি দেশগুলোর সাথে। এ মডেলটার নাম হচ্ছে কেবলের ক্লাব। পাঁচ ছয়টা দেশ মিলে করতো চুক্তিটা। ওই ক্লাবের মেম্বার তারাই। কার কতো ব্যান্ডউইডথ লাগবে সে হিসেবে ইনভেস্টমেন্ট করতো ওই কোম্পানিগুলো। স্যাটেলাইটের হাজারো ঝক্কি সামলাতে চাচ্ছিলো না দেশগুলো। চুক্তি ছিলো আগে থেকেই - আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য। এখন ফেলো তার পানিতে আর যুক্ত করো সবাইকে।
১৯.
ওই কেবলগুলোর পয়সা আসত ক্লাবের পার্টনারশীপ থেকে। সাবস্ক্রাইব করতো দেশগুলোর সরকারী কোম্পানি। এটিএন্ডটি, বিটি’র নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। তারাই ধরে ফেললো আন্তর্জাতিক বাজারটাকে। আর্লি মুভার্স অ্যাডভান্টেজ! কেবল বিছানো যা তা কাজ নয়। পারছিলো না সবাই করতে। ওদেরকে ‘ইনহাউস’ এক্সপার্টিজ দিতো কিছু স্পেশালাইজড কোম্পানি। সরকারী কোম্পানি। এটিএন্ডটিকে সাহায্য করছিলো ওর সাবসিডিয়ারি সাবমেরিন সিস্টেমস ইনকর্পোরেটেড। পরে সেটা এটিএন্ডটি থেকে কিনে নেয় টাইকো ইন্টারন্যাশনাল। মজার কথা - ভারতের ‘ভিএসএনএল’ এই টাইকো গ্লোবাল নেটওয়ার্ক আর টেলিগ্লোব কিনে হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাবমেরিন কেবল প্রোভাইডার। ‘ভিএসএনএল’কে তার আগেই বিক্রি করে দিয়েছিল ভারত সরকার – টাটা’র কাছে। প্রাইভেটাইজেশন ম্যাটার্স।
দেখবেন নাকি কিছু কেবল? বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছে এই কেবলগুলো!
২০.
কেবল সিস্টেমে ব্রিটিশদের আধিপত্য ছিলো দেখার মতো। আটলান্টিক সাগরের পুরোটাই প্রায় নিয়ে রেখেছিলো ১৮৫০ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত। তাদের সাপ্লাই আর ডিমান্ড সাইডে কিছু সুবিধা তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলো ওই পর্যায়ে। বৃটেনের অনেক উদ্যোক্তা পয়সা ফেলছিলেন পানিতে। আবার, ডিমান্ড সাইডে পৃথিবীব্যাপী তাদের বিশাল রাজত্ব থাকার কারণে শিপিং, নিউজ এজেন্সী, অন্যান্য ব্যবসা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিলো টেলিযোগাযোগে। আধিপত্য বোঝাতে নিয়ে আসি আরেকটা গল্প।
২১.
১৮৯৬তে তিরিশটা জাহাজ ছিলো কেবল বিছানোর কাজে। পুরো পৃথিবী জুড়ে। তার চব্বিশটাই ছিলো ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর। ১৮৯২তে পৃথিবীর দু-তৃতীয়াংশ কেবলের মালিকানা আর চালানোর দ্বায়িত্ব ছিলো ব্রিটিশদের। ১৯২৩শে এসে সেটা দাড়ায় তেতাল্লিশ শতাংশের মতো। সাগরে স্বল্পতম দূরত্বে কেবল বসানোতে ওস্তাদ ছিলো তারা। বিটিকে সাহায্য করতো ব্রিটিশ টেলিকম মেরিন। পরে ‘কেবল এন্ড ওয়্যারলেস’ আর ‘ব্রিটিশ টেলিকম মেরিন’ মিলে হয়ে যায় পরে ‘গ্লোবাল মেরিন সিস্টেমস’। পুরোপুরি বেসরকারী কোম্পানি। দক্ষতার শুরু ওখান থেকেই।
২২.
দেশগুলো টেলিযোগাযোগ খাত উন্মুক্ত করে দেবার ফলে উদ্ভব ঘটে কনসোর্টিয়াম কেবলের। এটার ফান্ডিং এসেছে অপারেটরদের ‘কনসোর্টিয়া’ থেকে। ক্লাব কেবলের পরের ক্যাটাগরি। দেশগুলোর বড় বড় সরকারী অথবা বেসরকারি অপারেটররা মিলে পয়সা ঢেলেছে নিজেদেরকে সংযুক্ত করার জন্য। এই আউটসোর্সের যুগে টেকনিকাল কাজগুলো দিয়ে দেয়া হয় স্পেশালাইজড সাপ্লাইয়ার্সদের।
২৩.
টাইকো ইলেকট্রনিকস আর অ্যালকাটেল-লুসেন্ট করে আসছে এই কাজ - অনেক বছর ধরে। কনসোর্টিয়াম মেম্বারদের দরকার অনুযায়ী এর ক্যাপাসিটি ডিজাইন থেকে শুরু করে কোথায় কোথায় যুক্ত হবে সেটাও সবাই বসে ঠিক করে নিজেদের মতো করে। কেবল বিছানো থেকে শুরু করে এর রিপেয়ার আর মেইনটেনেন্স কিভাবে হবে সেটার জন্য আলাদা ভাবে তৈরী করে ‘সিএমএ’। মানে কনস্ট্রাকশন এন্ড মেইনটেনেন্স এগ্রিমেন্ট কন্ট্রাক্ট। ষোলটা কোম্পানি মিলে করেছে সি-মি-উই-৪ কেবল কনসোর্টিয়াম। তৈরী করেছে অ্যালকাটেল-লুসেন্ট আর ফুজিত্সু মিলে। নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট করছে টাটা। পুরোটার খরচ পড়েছিলো ৫০০ ডলারের মতো।
২৪.
টেলিকম অপারেটর নয়, ওরকম কোম্পানিও বিনিয়োগ করছে এই কেবলে। প্রাইভেট ক্যাটাগরির কেবল এগুলো। এক কোম্পানির সাথে আরেক কোম্পানি অথবা কয়েক কোম্পানি মিলে ক্যাপাসিটি আনার জন্য তৈরী করে ফেলে কেবল কোম্পানি। হোলসেল বিজনেস হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাপাসিটি কেনা বেচা করে প্রাইভেট অপারেটররা। আফ্রিকার ‘সিকম’ হচ্ছে এধরনের কেবল। হিসেবে দেখা গেছে অপারেটর ‘কনসোর্টিয়া’ মোডে কেবল বসানো হয়েছে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। শেষের দিকে ৩৫টা অপারেটরের ‘কনসোর্টিয়া’ মিলে তৈরী করে টিএটি-৮।
২৫.
ট্রান্সআটলান্টিক-৮ এর পর উনিশশো নব্বইয়ের দিকে কনসোর্টিয়াম নয়, এমন দুটো কেবল তৈরী হয় প্রাইভেট ফান্ডিংয়ে। এরপর শুরু হয় প্রাইভেট কেবলের জোয়ার। উনিশশো নিরানব্বই থেকে দুহাজার একের মধ্যেই ২২ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট আসে এই প্রাইভেট কেবলে। আবার, উনিশশো আটানব্বই থেকে দুহাজার তিন পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর ৭০ শতাংশ কেবল বসে এই প্যাসিফিকের নীচে। এশিয়ার এমার্জিং ইকোনমিগুলো এজন্য দায়ী বলা চলে। পুরো ব্যবসা চলে আসছে এদিকে। দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পরছে এই কেবল দৌড়ে। ভবিষ্যত এখানেই।
২৬.
দুহাজার নয়ের ঘটনা। আফ্রিকাতে একটা কনফারেন্সে গিয়েছিলেন অফিসের এক কলিগ। আমার বদভ্যাস হচ্ছে কোথাও কেউ গেলে আগে থেকে অনুরোধ ফেলি বইয়ের। অথবা, বিভিন্ন হোয়াইট পেপারের। ‘পারলে নিয়ে আসবেন’ ধরনের। কনফারেন্সে অনেকেই তাদের ব্রোশিওর নিয়ে আসেন বলে সেগুলো সংগ্রহের বাতিক আছে আমার। ওভাবেই পেলাম একটা প্রাইভেট কেবলের কিছু হোয়াইট পেপার। ভয়ংকর সাহসী কাজ করে ফেলেছে তারা। অনেক আগেই। চিন্তাই করা যায় না!
২৭.
দেশগুলোর সরকারী কোম্পানিকে ডিঙিয়ে এমন একটা কেবল সিস্টেম তারা প্ল্যান করেছে যা হবে ওয়ার্ল্ড ক্লাস! হয়েছেও তাই। ফ্রাসট্রেশন থেকে এই কাজ। সীকম কেবলটা আমার পছন্দ আগে থেকে। স্ট্রাটেজিক ভাবে এটা কানেক্ট করেছে প্রায় সবাইকে। মাত্র ১৭,০০০ কিলোমিটার নিয়ে যাত্রা শুরু এদের। দুহাজার নয়ে। এপাশে লন্ডন আর ফ্রান্স। আফিকাকে পুরো বেঁধে চলে গিয়েছে এশিয়াতে। সাবমেরিন, টেরেস্ট্রিয়াল কম্পোনেন্ট - বাদ নেই কিছু এখানে। শেষ স্টপ মুম্বাই। বেঁধে ফেলেছে পুরো পৃথিবীকে। সীকমের পার্টনার কেবলগুলোর কথা আর নাই বা বলি।
২৮.
শুরুটা মজার। আফ্রিকার অন্যান্য টেলিকম অপারেটরের কেবল - কনসোর্টিয়ামের ব্যুরোক্রেসি’র জটিলতায় ক্লান্ত হয়ে সীকমের ইনভেস্টররা অন্য পথ ধরলেন। এমন একটা কেবল নিয়ে আসলেন যার মোদ্দাকথা হচ্ছে – ওপেন এক্সেস। সবার সমান প্রবেশাধিকার। এ পারবে, ও পারবে না – সরকারী কোম্পানি পারবে, অন্যরা পারবে না, এদেশ পারবে, ওদেশ পারবে না – ওই বৈষম্যতা ফেলে দিয়ে স্বচ্ছ ‘টার্মস এন্ড কন্ডিশন’ নিয়ে এলো সীকম।
২৯.
আফ্রিকার আরেকটা কেবল কনসোর্টিয়াম হচ্ছে ‘ইজি’। ছোট অপারেটররা মিলে কিভাবে একটা কেবল সিস্টেম তৈরী করতে পারে সেটার উদাহরন হচ্ছে এই ‘ইজি’। ছোটরা মিলে আগেই তৈরী করেছিলো ‘ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওশান কেবল কোম্পানি’ নামের কনসোর্টিয়াম। বড়দেরকেও নিয়েছিল পরে। অনেক লম্বা সময় আর সহজ শর্তে ঋণ পেলো কয়েকটা দাতাগোষ্ঠী থেকে। ওই ছোটদের কনসোর্টিয়ামটা। দাতাগোষ্ঠীও চমত্কার একটা কমিটমেন্ট পেলো তাদের কাছ থেকে। ব্যান্ডউইডথ বিক্রি হবে ‘কস্ট বেসড’। মুনাফা নয়, প্রোডাকশন কস্টে। ক্যাপাসিটি ভাগাভাগি হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। সবার মধ্যে। কনসোর্টিয়াম মেম্বার আর যাদের মেম্বারশিপ নেই, সবার জন্য দাম হবে একই। এই হচ্ছে আফ্রিকা।
Last updated
Was this helpful?