৬.১ ঠিক আছে তো প্রতিযোগিতা?

No policy that does not rest upon some philosophical public opinion can be permanently maintained.

- Abraham Lincoln

৫২৬.

আরেকটা দাম কমানোর টুলে আসি আজ। এটা আরেকটা রেগুলেটরি টুল, নাম এসএমপি। মানে সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার। বাজারে প্রতিযোগিতা ঠিকমতো আছে কিনা সেটা দেখার দ্বায়িত্ব রেগুলেটরের। একাজে ‘কম্পিটিশন এজেন্সী’ একটা বিশেষায়িত সংস্থা। ওটা যতদিন না আসছে – ততোদিন টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরের কাজ এটা। ডাব্লিউটিও, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এটা নিয়ে কাজ করছে অনেকদিন ধরে। কোন দেশে ঠিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা না থাকলে ক্ষতি সবারই। ক্ষতি ছোট কোম্পানিগুলোর। সবচেয়ে ক্ষতি গ্রাহকের। গ্রাহক কখনো জানতে পারেনা প্রোডাক্টটার আসল দাম কতো। বাজার হারায় তার দক্ষতা। তৈরী হয়না বিকল্প পণ্য। ফলে দাম কমে না ইন্টারনেটের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের।

৫২৭.

সাপ্লাই সাইডের সমস্যা নিরসনে ডাব্লিউটিও’র চুক্তিতে আমরা আছি কিন্তু। তবে নীতিমালার প্রযোজ্যতা নেই খুব একটা। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে এটা দেখে কোর্ট, তবে বাকি প্রায় সব দেশে সুস্থ্য প্রতিযোগিতার মানদন্ড নির্ধারণ করে থাকে কোম্পানিগুলোর মার্কেট শেয়ারের ওপর। অনেক কোম্পানি থাকার অর্থ এই নয় যে বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা বহাল আছে। এটা বের করারও অংক আছে কয়েকটা। দু-একটা কোম্পানি যদি বাজারের বেশি অংশ ধরে রাখে তাহলে দামটাও কিছুটা ‘ডিস্টর্টেড’ হয়ে পড়ে। এখানে জিনিষটার আসল দামটা কতো হওয়া উচিত সেটা বের করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কয়টা জিনিষের ‘কস্ট-মডেলিং’ করবেন আপনি? দু-একটা কোম্পানির পণ্য বাজারের অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করলে তৈরী হয় সমস্যাটা। বাজারে অন্য কোম্পানিগুলো থাকলেও প্রতিযোগিতামূলক ব্যাপারটা নিয়ে কেউ দেখভাল না করলে ‘মার্কেট ফেইলুর’ হবার সম্ভাবনা বেশি। ফলে – দাম আর কমে না। অথচ, উত্পাদন খরচ এর অর্ধেক। উদাহরন দেই বরং।

৫২৮.

ব্যবস্যা আমার মুড়ির। বাংলাদেশের ষাটভাগ বাজার আমার হাতে। কারণ, আমি ঢুকেছি বাজারে আগে। আমার ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক বড় অনেক। সরকারের সব লোককে চেনা আমার। প্রতিযোগীরা ধারে কাছে নেই আমার। পনেরো দশ শতাংশ নিয়ে আছে বাকিরা। আমার মুড়ি একদম প্রান্তিক পর্যায়ে যায় বলে ওটার বিকল্প হিসেবে ধারে কাছে যেতে পারেনি অন্যরা। পয়সা বেশি থাকায় প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর কয়েকটাকে কিনে নিলাম আমি। সাদা চোখে এখানে সমস্যা না থাকলেও প্রতিযোগিতা না থাকায় দাম বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। কম্পিটিশন এজেন্সি থাকলে কোন কোম্পানি বাজারের একটা নির্দিষ্ট শতাংশের ওপরে গেলেই তার মুনাফা বের করে সেটার আসল দামের কাছাকাছি একটা দাম বেঁধে দিতো। টেলিকমে কম্পিটিশন রেগুলেশন আরো ভয়াবহ। ডোমিন্যান্ট মানে বড় অপারেটরের হাজারো আন্ডারটেকিং। আর তার বড় হবার ক্ষমতাকে অপব্যবহার করলে হয় কোর্ট কাচারী।

৫২৯.

সেই উনিশশো সাতানব্বইতে ইউরোপিয়ান কমিশন চারটা বাজার নির্ধারণ করে এই টেলিকমেই। মোবাইল, ফিক্সড লাইন মানে টিএন্ডটি, লীজড লাইন আর ইন্টারকানেকশন মার্কেট যার মাধ্যমে যুক্ত থাকে অপারেটররা দেশে বিদেশে। কারো বাজার কোন ভাবে ২৫% বা ওর ওপরে গেলেই তাকে এসএমপি মানে সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার হিসেবে ধরা হয়। এসএমপি হলে তার নেটওয়ার্কে অন্য প্রতিযোগীরা যারা ঢুকবে – তাদেরকে দিতে হবে আসল দামে। প্রোডাকশন কষ্টের কাছাকাছি। মুনাফার দামে নয়। তার নেটওয়ার্ক এলিমেন্টগুলোতে আলাদাভাবে এক্সেস চাইলে সেটা দিতে বাধ্য।

[ক্রমশঃ]

A conspiracy is nothing but a secret agreement of a number of men for the pursuance of policies which they dare not admit in public.

- Mark Twain

৫৩০.

ধরা যাক আপনি আইএসপি, চালাতে চান ডিএসএল। টিএন্ডটির লোকাল লুপ (কপার ইনফ্রাস্ট্রাকচার) আন-বান্ডল মানে খুলে দিতে হবে প্রতিযোগীদের কাছে। মুনাফার দামে নয়। জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করতে হবে তার সব রেফারেন্স ইন্টারকানেকশন অফার। ‘আরআইও’, রেফারেন্স ইন্টারকানেকশন অফার হচ্ছে গিয়ে আপনার নেটওয়ার্কের এলিমেন্টগুলোতে প্রতিযোগীদের এক্সেস দিতে গিয়ে তার দাম জানাতে হবে সবাইকে। অনেক দেশে রেগুলেটর সেটাকে দেখে দেয় আগে থেকে। বড় অপারেটর আবার দাম কমিয়ে বাকিদের মার্কেট থেকে উধাও করে না দিতে পারে সেজন্যও আছে ব্যবস্থা। ধরে দেয়া হবে তার দাম। নামতে পারবে না ওখান থেকে।

৫৩১.

থাইল্যান্ডে একটা রেগুলেটরি কোর্সে গিয়েছিলাম এবছর। ওদের ‘আনফেয়ার কম্পিটিশন নীতিমালা ২০০৬’ বলছে একই কথা। পঁচিশ শতাংশের ওপরে গেলেই ওই অপারেটরের ওপর নির্দেশনা আর নজরদারি আলাদা। হোলসেল এক্সেসে একেকজনকে একেক দাম আর শর্ত দিলেই বিপদে পড়বে সে। ‘বটলনেক রিসোর্স’গুলোতে (হতে পারে ব্যাকহল) এক্সেস কমিয়ে দিলে ধরবে রেগুলেটর। দরকারী তথ্য গোপন করলে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হবে ডোমিন্যান্ট অপারেটরকে। অন্যকে দিলাম না এক্সেস, টেকনিক্যালি সমস্যা করে রাখলাম – সেটা প্রমাণিত হলে আরো বিপদ। খুচরা ব্যবস্যায় এমন দাম দিলাম – বাকিরা বিপদে। সেটা পারবে না ডোমিন্যান্ট অপারেটর। একটা সার্ভিসের সাথে আরেকটা বান্ডলিং অথবা এটা না কিনলে ওটা পাবেনা বললেই ‘মার্কেট অ্যাবিউজে’ পড়ে যাবে সে। ভালো চলছে প্রোডাক্টটা, কমিয়ে দিলাম সরবরাহ – ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে ধরা হবে সেটাকে। কয়েকটা কোম্পানি মিলে যদি দাম এক রাখে, তাহলেও একই অবস্থা।

৫৩২.

মোদ্দা কথা – সুস্থ্য প্রতিযোগিতা নীতিমালা আর বড়দের ক্ষমতার অপব্যবহারগুলোকে নজরদারিতে নিয়ে এলে অপারেটররা নিজেরাই দাম কমিয়ে আসল দামের কাছে নিয়ে আসবে। আসল মানে প্রোডাকশন কষ্টের কাছাকাছি। সুস্থ প্রতিযোগিতার নীতিমালা জানে কিন্তু রেগুলেটর। ওই নীতিমালা মানলে খরচ কমে আসবে অপারেটরদের। নিট রেজাল্ট – দাম কম। সুস্থ্য প্রতিযোগিতার মাপার অংক আছে একটা। নাম হার্সম্যান হারফিণ্ডল ইনডেক্স। সংক্ষেপে এইচএইচআই। এর মান শূন্য হলে বোঝা যায় বাজারে ছোট কোম্পানি আছে অনেকগুলো। দশ হাজার হলে বাজারটা চলছে পুরো মনোপলিতে।

৫৩৩.

ধরে নেই – আমাদের সম্পর্কিত বাজার হচ্ছে মোবাইল সার্ভিস। বাজারে আছেও চার চারটা কোম্পানি। মার্কেট শেয়ার হিসেবে বড় অপারেটরের আছে পঞ্চাশ ভাগ। বাকিদের বাজার দখল আছে ৩০, ১০ আর ১০ শতাংশে। বাজারের এইচএইচআই ইনডেক্স হচ্ছে গিয়ে ২,৫০০ %২০ ৯০০ %২০ ১০০ %২০ ১০০ = ৩৬,০০। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে যদি দুটো কোম্পানি একত্রীভূত (মার্জার) হতে গেলে এধরনের একটা হিসেব করে সেটার বিপদসীমা পার না হলে ভালো সবার জন্য। সবুজ বাতি পায় কোম্পানিগুলো। এক হাজারের নিচে হলে ধরা হয় প্রতিযোগিতা কম। হাজার থেকে আঠারোশো – মধ্যম আর তার ওপরে গেলেই প্রতিযোগিতা আছে বাজারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে একই ধরনের তবে সেটার গল্প কিছুটা বড়। নিয়ে আসবো আরেকদিন। ‘এসএমপি’ অপারেটরের মার্কেট অ্যাবিউজ বা তার ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে আসছি সামনে। নাহলে রেগুলেটর জানবে কিভাবে? মানে, কোথায় সমস্যাটা?

[ক্রমশঃ]

Last updated

Was this helpful?