৬.৩. নেট নিউট্রালিটি, ভাবছেন কেউ?
জিরো ইন্টারনেট, এক
ইন্টারনেট নিয়ে সখ্যতা আমাদের অনেক অনেক দিনের। আমাদের মানে আমাদের মতো বুড়োদের। ইন্টারনেট বড় হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। বিরানব্বই থেকে অফলাইন ইন্টারনেট নিয়ে খোঁচাখুচি। ব্রাউজও করতে পারতাম এই অফলাইন ইন্টারনেটে। ভাবা যায়? ভাবখানা কিছুটা আজকের পুশ-পুল এসএমএসের মতো। যাই হোক - জানা যেতো অনেক কিছু। সত্যি কথা বলতে - 'লোকাল ইন্টারনেট' মানে মোডেম দিয়ে এক বাসা থেকে আরেক বাসায় ফাইল পাঠানো শুরু হয়েছে বহু আগেই। তিরাশি সালের কথা। হাতে পড়লো একটা 'কমোডোর' কম্পিউটার। মোডেমসহ। পাল্টে গেল আমাদের দুনিয়া। এক সময় চালু হলো বুলেটিন বোর্ড সার্ভিস। এই ঢাকায়! মনে আছে 'ওয়াইল্ড ক্যাট'এর প্রম্পটের কথা? কথাটা আপনাদের কাছে 'হিব্রু' মনে হলে বুঝতে হবে আসলেই বুড়ো হয়েছি আমরা।
আজকের ইন্টারনেট পাল্টে দিচ্ছে পৃথিবীকে। কোথায় কি হলো সেটা সরকার জানার আগেই জানে মানুষ। মানে জনগণ। জনগণ তার মুখ খুলতে পারে এই ইন্টারনেটের কারণে। 'আরব বসন্তে'র দেখেছেন কি, ওটাতো আইসবার্গের ছোট্ট 'নিষ্পাপ' মাথা। আজকের গনতন্ত্রের বিশাল অংশ চলছে এই ইন্টারনেটকে ঘিরে। আল গোরের 'ইন্টারনেট আর ভবিষ্যত গনতন্ত্র' নিয়ে বক্তৃতা কিছুটা গল্প দিলেও তার সবকিছু শুরু কিন্তু একটা সহজ 'টার্মেনোলোজি' নিয়ে। 'নেট নিউট্রালিটি'। পুরো ইন্টারনেট 'সরব' এই গল্পটা নিয়ে। হ্যা, প্রায় একযুগ ধরে। আমরা যারা ভোক্তা, তাদের ভয় একটাই। কোনদিন না বন্ধ হয়ে যায় সব। আমার প্রিয় সাইট হয়তোবা হারিয়ে যাবে এই টেলকোদের ধাক্কাধাক্কিতে। সাইট থাকবে, কিন্তু সেটাকে আর বইবেনা (মানে আর 'ক্যারি' করবে না) আমাদের 'টেলকো'রা। কারণ বনিবনা হয়নি পয়সার ভাগ বাটোয়ারাতে। অপারেটর 'ক' এর ওপর দিয়ে ওই অ্যাপ্লিকেশন বা সাইট আসতে হলে পয়সা দিতে হবে ঘাটে ঘাটে। সব দোষ জর্জ অরওয়েলের। কেন লিখতে গেলেন বইটা? মানে ১৯৮৪ নামের বইটা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কম্যুনিকেশন কমিশনকে (আমাদের বিটিআরসি'র মতো) কম ধকল পোহাতে হয়নি এটাকে নিয়ে। এটা নিয়ে অনেকবার আলাপও হয়েছিল বেশ কিছু রেগুলেটরদের সাথে। 'এফসিসি'সহ। বিলিয়ন ডলারের অপারেটরদের কথা একটাই। ডাটা পাইপ দিচ্ছি আমরা। আমরা জানি কাকে আটকাবো আর কাকে নয়। ভাবখানা এমন, পয়সা না দিলে ফেলে দেবো 'স্লো' জোনে। ভয়ংকর কথা। অথচ পাইপের টাকা নিচ্ছে কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকে। দরকার আরো টাকার। এখন টাকার খেলা। ক্যারিয়াররা ভালো করেই জানেন মোবাইল ডাটার ৮৫% রেভিনিউ হারাবেন ওয়াইফাই প্রোভাইডারদের কাছে। ২০১৮ সালের পরে। তবে টাকা রয়েছে এমুহুর্তে। তাদের কাছে। অনেক দেশের রেগুলেটর হার মেনেছে তাদের কাছে। বিনি পয়সায় দিচ্ছি ইন্টারনেট। কার কি বলার আছে?
কিন্তু সেটাই 'বিভক্তি' তৈরি করছে ইন্টারনেটে। আজ সচলায়তন, কাল সামহোয়ারইনব্লগ। অ্যাক্সেস পাবে কি না সেটা নির্ভর করবে টেলকো'র ওপর। এই 'জিরো ইন্টারনেট' ক্যাম্পেইন হচ্ছে তার 'নিষ্পাপ' মুখ। আজ সুবিধা দেয়া হচ্ছে ফেসবুককে। কাল দেয়া হবে 'উইকি'। পরশুদিন আপনার তৈরি অ্যাপকে ব্রাউজ করতে হবে গাটের পয়সা খরচ করে। রেগুলেটর কি পারে ফেসবূককে সুবিধা দিতে? আলাদাভাবে? আপনার অ্যাপ অথবা সাইটের ওপর? ফেসবুকের পয়সা আছে বলে ও পাবে 'জিরো ইন্টারনেট', আর আপনি? আপনার দোষ কোথায়? আপনি দেশী কোম্পানী তাই? আবার আপনার মামা চাচা মানে 'পয়সা' আছে বলে অ্যাক্সেস পাবেন আর ভিন্ন মতাবলম্বী হলে সাইট পড়ে থাকবে 'স্লো' জোনে।
ইন্টারনেট কিন্তু তৈরি হয়নি এজন্য। এতোদিন আপনি অপারেটর 'ক' তে থাকলেই কল করতে পারতেন 'হেলথকেয়ার' কলসেন্টারে। অপারেটর 'খ'য়ের গ্রাহকদের কি দোষ? 'কৃষি জিজ্ঞাসা'তে কল করতে পাল্টাতে হবে সিম আবার। ওই সিমের পয়সাটা দেবে কে শুনি? এই তো দেখে আসছি টেলকো'দের 'ওয়ালড গার্ডেন' মানে তৈরি করা 'ইচ্ছে কুপে'। ইন্টারনেট এসে উড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু। ফেসবুকে যেতে আলাদা করে সংযোগ নিতে হয় না আপনাদের। ইন্টারনেট নামের মহাসড়কে সংযোগ থাকলেই হলো। এই ইন্টারনেটই তৈরি হয়েছে হাজারো মতের ওপর দিয়ে। সহিষ্ণুতা এর বড় চাবিকাঠি। সব ধরনের মত নিয়ে তৈরি হয়েছে এই বিশাল সীমানাহীন দেশ। সব মত যে ভালো লাগবে সবার - সেটাও নয়। আপনার ভালো না লাগলে সেখানে না গেলেই হলো। আপনাকে তো বন্দুকের মুখে নিয়ে পড়তে বলেনি তার ব্লগ পোস্ট। এটা এমন যে আমার ধর্ম পালন করছি আমার পরিমণ্ডলে। অন্যকে না খোচালেই তো হলো। আপনার খোঁচা লাগলে উত্তর তৈরি করুন যুতসই। নয় গালাগালি।
প্রথম প্রথম সার্চ ইঞ্জিন বের হলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো মানুষ। নব্বইয়ের শুরুর ঘটনা। 'সেক্স' শব্দটা ছিলো এক নম্বরে। কই সার্চ ইঞ্জিন 'ব্যান' করেনি জিনিসটাকে। নিষিদ্ধ করলেই বরং বাড়ে ব্যাপারটা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের তার অনেক গুণের মধ্যে বিচার বুদ্ধিটা দিয়েছেন আগে। সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি বলে হয়তোবা। কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ সেটাকে বেছে নিতে পাঠানো হয়েছে আমাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে। নিজের দেখভাল নিজের। আর সেকারণে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। বাচ্চাদের দেখভাল করার দ্বায়িত্ব আমাদের। তাই কম্পিউটারটা এনে রাখা ওপেন স্পেসে। আর সবকিছুর খারাপ ভালো দিক আছে বলেই হাজারো 'নিষিদ্ধ' জিনিস পাওয়া যায় এখানে সেখানে। পৃথিবী তো আর স্বর্গ নয়, এটা পরীক্ষার যায়গা। ভালো কাজের পুরস্কার আছে সব ধর্মে। যারা সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন না সেটাও একটা ধর্ম। সেটাও একটা 'অ্যাট্রিবিউট'। পদার্থের ধর্মের মতো।
ইন্টারনেটে সবকিছু আছে বলেই এখানে সহিষ্ণুতাটা লাগেও বেশি। নব্বইয়ের দিকে 'ইউজনেট' ব্যবহার করতে হতো আমাদের। যেকোন সমস্যার জন্য। বিশেষ করে 'ইউনিক্স' অপারেটিং সিষ্টেমটা নিয়ে কাজ করার সময়। আমরা জানি 'সহিষ্ণুতা'র দাম কেমন। আর সেকারণে হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছে ওই অপরিচিত 'বন্ধুসুলভ' মানুষগুলো। পৃথিবী চষে বেড়ানোর সময় দেখা হয়েছে তাদের অনেকের সাথে। তারা জানেন ইন্টারনেট তৈরি হয়েছে ওই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে। যারা ইন্টারনেট বোঝেন না তারাই সারাদিন আমাকে (বিটিআরসিতে থাকাকালীন) বলতেন এটা বন্ধ করেন, ওইটা বন্ধ করেন। অথবা, 'ইউটিউব' বন্ধ করতে এতো সময় নিচ্ছেন কেন? সত্যি বলতে, আমাদের নীতিনির্ধারণীতে বসে থাকা মানুষগুলোও বন্ধ করতে চাননা সবকিছু। জনপ্রতিনিধিরা থাকেন বিপদে। 'অসম্ভব' চাপ তৈরি করেন 'ইন্টারনেট' না বোঝা আশেপাশের মানুষজন। এই আমরাই। 'সূর্যের চেয়ে বালি গরম'এর মতো ব্যাপারটা। ফেসবুকে আমাদের কমেন্ট দেখলে মনে হয় 'শিষ্ঠাচার' ১০১ কোর্স দরকার অনেকের। কেন জানি সমালোচনা নিতে পারিনা আমরা। তবে, আশাবাদী আমি। 'সত্যিকারের শিক্ষা'র সাথে সাথে পাল্টাবে এই ট্রেন্ড।
ধরুন, সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়েছেন আপনি। একা পেয়ে 'বাঘমামা' আঁচড় দিয়ে বসলো আপনাকে। ঢাকায় ফেরত্ এসে গরম হয়ে বললেন, আচড় দিলো কেন সে? প্রথম কথা হচ্ছে, আপনার 'স্বাধীনতা' নিয়ে ঢুকে গিয়েছিলেন গহীন বনে। বাঘমামা তার 'স্বাধীনতা' ব্যবহার করে আঁচড় দিয়ে দিয়েছে - এই যা! আগুন তো সবকিছু পুড়িয়ে দিতে পারলেও সেটাকে তো আর 'ব্যান' করেননি আপনার সুবিধার জন্য। হাজারো হ্যাকিংয়ের ঘটনা চলছে বিশ্ব জুড়ে, কই কেউ তো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নেই বসে। সেটাতো - চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে বসে ভাত খাওয়ার মতো। ইন্টারনেটে কে কি বললো, সেটাকে আটকাতে যাওয়া কেন? রাস্তায় তো পাগলও অনেক কিছু বলে, সেটাকে ছাড় দিলে ইন্টারনেটকে নয় কেন? রেগুলেটর হিসেবে অনেক ব্যাপার নিয়ে 'আলাপ' করে মধ্যপন্থী অবস্থান নিয়েছিলাম আমার ওই সাত সাতটা বছরে।
বুকে হাত দিয়ে বলুনতো আজ 'ইউটিউব' বা 'ফেসবুক' বাংলাদেশী ইনকরপোরেটেড কোম্পানী হলে বছরে বন্ধ হতো কতো বার? কতো কনটেন্ট মুছে যেতো প্রতিদিন? আমার কথা একটাই। আপনার ভালো না লাগলে ওই সাইটে যাওয়া কেন বার বার? আর, ও মিথ্যে বললে কি উড়ে যাচ্ছে আপনার 'ঠুনকো' ইমেজ? 'রেড লাইট এরিয়া'র মতো প্রতিটা 'পর্নোসাইট' বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগেনি পৃথিবী। সময়ের দাম আছে মানুষের। 'নিষিদ্ধ' কনটেন্টের সাইটে না যাবার জন্য নিজের ওপর ভরসা নেই কেন আমাদের? কেন সরকারকে বলা - 'এটা ওইটা বন্ধ করেন'? রাস্তায় নামলেই দুর্ঘটনা হয় বলে ঘরে বসে থাকেন আপনি? আর, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ থাকবেই। সবার মত তো আর এক হবে না। তাহলে, অন্যের মুখ বন্ধ করতে যাওয়া কেন? ওতো আপনার বাড়া ভাতে ছাই ফেলেনি। আপনার মতের বিরুদ্ধে কথা বলেছে হয়তোবা। এই যা! আর - উত্তরে দাড়া করান আপনার মতামত। এমনও তো হতে পারে সে ঠিক। গ্যালিলিওকেও তো মিথ্যেবাদী বলেছিল মানুষ।
আর সেকারণে আমার ভয় এই 'জিরো ইন্টারনেট' নিয়ে। আজ যা জিরো, সামান্য গুটিকয়েকের জন্য, কাল আপনাকে তারাই ফেলে দিতে পারে 'স্লো' জোনে। পরশুদিন 'নো জোন'। মানে, পাওয়া যাচ্ছে না আপনার সাইট - দেশ থেকে। 'ইন্টারনেট' বৈষম্য করেনি কখনো। বৈষম্য তৈরি করে না প্রযুক্তি, তৈরি করি আমরা। মানুষেরা। একে ওকে 'শূন্য ট্যারিফ' - আর বাকিদের নয়, সেটাই মূলনীতির বাইরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি নিয়ে হাজারো গল্প থাকলেও দেশের ভেতরে এই 'সহিষ্ণুতা' তাদেরকে 'মাতবরী' করতে দেবে অনেক কটা বছর। সহিষ্ণুতা মানে 'অন্যের মতামতকে নেবার ক্ষমতা'। কারণ - তারা জানে ভিন্ন মতের মাহত্ব। আর সেকারণে ওই দেশের ফাউন্ডিং ফাদাররা তৈরি করেছিলেন 'বিল অফ রাইটস' বলে একটা কাগজ। সাদামাটা কথা। দেখবেন নাকি পড়ে একবার? ওই ১৭৮৭ সালে থমাস জেফারসন কি বলেছিলেন মনে আছে কি? "[A] bill of rights is what the people are entitled to against every government on earth, general or particular, and what no just government should refuse."
ফ্রীডম অফ স্পীচ? কি হবে সেটার? বলেন 'জিনিসপত্র' যা ইচ্ছা, উত্তর দেবো কথায়। হাতাহাতি নয়। সমস্যা একটা যায়গায়। আমরা কেন জানি গুলিয়ে ফেলি 'হেট স্পীচ', 'ফ্রীডম অফ স্পীচ'এর সাথে। খোঁচাখুচি করেন ভালো কথা, বিদ্বেষ নয়। 'বিষেদগার' অন্য জিনিস। আর সবার স্বাধীনতা আছে তার নিজ জিনিস নিয়ে। একটা ঘটনা বলি বরং। কয়েক দিন আগের কথা। পুরো ইন্টারনেট গরম এটা নিয়ে। উন্নত বিশ্বে মহিলারা যে কতো বেশি নিগৃহীত হন সেটার ঘটনা একটা। মহিলা টেলিভিশন রিপোর্টারদের নিয়ে অনেকদিন ধরেই চলছে জিনিসটা। গুগল করুন, 'এফএইচআরআইটিপি' দিয়ে। সঙ্গে 'সিবিসি' কীওয়ার্ড ব্যবহার করলেই বুঝতে পারবেন তাহলে। শেষ ঘটনা 'সিবিসি নিউজ'এর রিপোর্টার শ্যনা হান্টকে নিয়ে।
লাইভ রিপোর্টারদের চলন্ত ঘটনায় আর যাই হোক না কেন সেটাকে সপ্রতিভভাবে চালিয়ে নেয়ার প্রশিক্ষণ তাদেরকে কাবু না করলেও ব্যাপারটা রীতিমতো কষ্টের। ভিডিও দেখে মনে হলো সেটা। বিশেষ করে মহিলা রিপোর্টারদের। একটা খেলার পর দর্শকদের মতামত নিতে গিয়ে বিপদে পড়েন হান্ট। তবে তার সাহসের তারিফ করি। দর্শক তার 'বাক স্বাধীনতা' ব্যবহার করে যা ইচ্ছা তাই বললেও সেটা তার নেটওয়ার্ক 'নিজস্ব স্বাধীনতা' ব্যবহার করে ছেড়ে দেয় ইউটিউবে। বিতর্কের ঝড় ওঠে ওই ইউটিউব চ্যানেলে। সেটা ছড়িয়ে পড়ে 'মেইন স্ট্রিম' মিডিয়াতে।
তারপরের ঘটনাটা আরো মজার। দর্শকদের চাকরিদাতা কোম্পানীও 'নিজস্ব স্বাধীনতা' ব্যবহার করে চাকরি খেয়েছে তাদের। একারণে আমার পছন্দ এই ইউটিউব। মানে, ইন্টারনেট। আপনার তথাকথিত 'স্বাধীনতা' ব্যবহার করলেই তো আর হবে না। আমারো তো রয়েছে 'স্বাধীনতা'। আমার স্বাধীনতা এই ইন্টারনেট। আর তাই এই 'জিরো ইন্টারনেট' নিয়ে দিচ্ছি এতো গল্প। ইন্টারনেট হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় 'ইকুয়ালাইজার'। দেয় 'লেভেল প্লেয়িং ফীল্ড'। ভাঙতে দেয়া যায় না একে। তাও আবার এই 'জিরো ইন্টারনেট' দিয়ে বৈষম্য তৈরি করে?
ফেসবুকই তো একটা বড় মহাদেশ। সবই আছে এই ইন্টারনেটে। না গেলেই হলো। আগুনের মতো। রান্না করুন ওটা দিয়ে। অন্যের বাড়ি পোড়াতে না গেলেই হলো।
আমাদের মতো দেশে 'সংযোগ বিরোধী' হিসেবে চিহ্নিত করবেন সবাই। এই আমাকে। কথা ঠিক আপনার। বিনি পয়সায় দিলে ক্ষতি কি শুনি? নাই মামার থেকে কানা মামা তো ভালো, তাই না? সত্যি তাই। তবে, আসলে কি তাই? 'জিরো ইন্টারনেট' ব্যাপারটা বিভ্রান্তিকর। আমাদের বিশাল একটা শতাংশের মানুষ ভাবে, ফেসবুকই ইন্টারনেট। অথচ, ফেসবুকে সত্যের পাশাপাশি চলছে হাজারো গল্প। সত্যি কি সবই? হতাশ হই, বিশাল একটা জনগোষ্ঠী পড়ে আছে এই এক সাইটে। আমরা বড় হচ্ছি ফেসবূককে 'ইন্টারনেট' ভেবে। পুরো জনগোষ্ঠীর কতোটা সময় নষ্ট হচ্ছে একটা ফুলপ্রুফ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের অভাবে।
কুপের মতো ব্যাপারটা। যা হয়তোবা আসল ইন্টারনেটের 'শূন্য দশমিক' কিছু শতাংশ হতে পারে। অথবা নামমাত্র আরো ২৮টা সাইট। বের হতে পারছে না ওই গন্ডি থেকে। সবার কথা একটাই, কয়েকটা সাইটকে এই 'এক্সক্লুসিভ' সুযোগ না দিয়ে সবাইকে দিন অ্যাক্সেস। আগের মতো। বরং চার্জ করুন একটা সহনীয় মাত্রায়। আমাদের মধ্যম আয়ের মানুষদের কথা মাথায় রেখে। আজ যা ইন্টারনেট গ্রাহক, তা তৈরি হয়েছে এই 'অসহনীয়' চার্জের ভেতরে থেকেই। কমিয়ে দিলে সুবিধা হয় সবার। 'চ্যারিটি' করতে বলছে না কেউ।
এই ফাঁকে ছোট্ট একটা গল্প পাড়ি, কি বলেন? 'আসল ইন্টারনেট' কিন্তু ভয়াবহ রকমের বড়। আমরা যা দেখি, মানে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন যেগুলোকে খুঁজে পেতে নিয়ে আসে সেটাও কিন্তু আসল ইন্টারনেটের একটা ছোট্ট ছোট্ট ভগ্নাংশ। ওর একটা নাম আছে। ডীপ ওয়েব। 'ডীপনেট' বলেন অনেকে। আমরা বলি 'অদৃশ্য' অথবা 'লুকানো' ইন্টারনেট। সার্চ ইঞ্জিনকে মাছ ধরার জাল হিসেবে তুলনা করে পৃথিবীর সব সমুদ্রকে যেভাবে ছেঁকে আনা সম্ভব নয়, সেভাবে হাজারো জিনিস থেকে যায় আমাদের দৃষ্টির বাইরে। সিকিউরিটি স্পেশ্যালিস্টের মাথা ব্যাথা শুরু ওখানেই।
এডওয়ার্ড স্নোডেনের কাগজ ঘাটলে পরিষ্কার হবে আরো। সার্চ ইঞ্জিনের মাতবরী ওই 'সারফেস' ওয়েব পর্যন্ত। আইসবার্গের চূড়াটাই হাতের নাগালে তাদের। আচ্ছা, ডীপ ওয়েব মানে ডার্ক ওয়েব - যা তৈরি হাজারো বেনামী নেটওয়ার্ক নিয়ে (ধরুন টর নেটওয়ার্ক, টেইলস, আইটুপি - যেটা নেটওয়ার্কের ভেতরের নেটওয়ার্ক ... বেহুস হয়ে যাবার যোগাড়) - কতো বড় হতে পারে আমাদের 'সারফেস' ইন্টারনেট থেকে? অনেক আগের একটা এষ্টিমেশন থেকে জানা যায় 'ডীপ ওয়েব' নিদেনপক্ষে ৪০০ থেকে ৫৫০ গুণ বড়। তাও সেটা অনেক বছর আগের হিসেব। এখন যোগ হয়েছে আরো অনেক কিছু। ভয় ধরানো পেশা নয় আমার। ফিরে আসি - সাধারণ ইন্টারনেটের 'অস্তিত্বে'র গল্প নিয়ে।
কাল পত্রিকা 'প্রথম আলো' যদি পয়সা দেয়, তাহলে তারাও তো পাবে তথাকথিত 'জিরো ইন্টারনেট', 'যুগান্তর' করবে কি তখন? আজ আপনি একটা ব্লগ তৈরি করতে পারছেন মিনিটের মধ্যে, পয়সা না দিলে কি হবে তখন? এই 'জিরো ইন্টারনেট'এর বাইরের লিংকে ক্লিক করলে পারবেন কি যেতে? না যেতে পারলে সেটা কিভাবে হলো ইন্টারনেট?
আর যেতে পারলে সেটার পয়সা দেবে কে? ফেসবুকের হাজারো পাতায় 'এমবেড' করা আছে 'ইউটিউব' ভিডিও। গ্রাহক জানেনও না পয়সা কাটা হচ্ছে উচ্চ রেটে। থাকছেন ফেসবূক পাতায়, অথচ কেটে নিচ্ছে পয়সা। 'জিরো ইন্টারনেট' নামের এই 'ওয়ালড গার্ডেন' মানে কুপের মধ্যে থাকার অর্থ হয় কোন? আর লিংকে ক্লিক করলে আলাদা 'ল্যান্ডিং পাতা' কি আসে গ্রাহকের কাছে? 'সতর্কতা - এর বাইরে গেলে দিতে হবে পয়সা!' এধরনের কিছু মেসেজ? অনেকেই অভিযোগ করছেন পয়সা কেটে নেয়ার ব্যাপারে। ইন্টারনেট হচ্ছে 'লিংকে' 'লিংকে' ক্লিক করে যেকোন যায়গায় যাবার স্বাধীনতা, কি হবে সেই মূল মন্ত্রের? কষ্ট পাই যখন পাখা ছেটে ফেলা হয় এই বিশাল সম্ভাবনার। আমাদের মতো দেশগুলোতে। অথচ বিলিয়ন ডলার আয় করতে হবে এর হাত ধরে। সামনে।
বলছেন বিনি পয়সার ইন্টারনেট, ওখানেই সমস্যা আমার। ফেসবুক আর টুইটার তো পুরো ইন্টারনেট নয় আর। আর নয় 'কিছু' 'কিছু' সাইট। বৈষম্য নেই বলে ইন্টারনেট আজ এখানে। এই কনটেন্ট 'ফ্রী' আর ওটা নয়, সেটাই তৈরি করবে তথ্যের বৈষম্য। পয়সা দিলে গতি পাবে আপনার সাইট, আর না হলে বসে থাকুন 'স্লো' জোনে। নেটফ্লিক্সের গল্প শুনেছেন অনেকে। আগে সিনেমা দেখতাম ভিডিও সিডি ভাড়া করে। আর এখন, ইন্টারনেট থাকতে ওই দোকান পর্যন্তই বা যাওয়া কেন? ভিডিও স্ট্রীমিং দেখতে দরকার ভালো ব্যান্ডউইডথের। আর নেটফ্লিক্স কোম্পানীর চলছিলো ভালোই - এই ব্যবসা করে। এরপর হটাত্ করেই ওই ব্যান্ডউইডথ কমিয়ে দিলো অপারেটররা গ্রাহকেরা যখন মুভি দেখা শুরু করলো ওই নেটফ্লিক্সে।
ভিডিও স্ট্রীমিং চালায় অ্যামাজনও। এখন এ বলে পয়সা দাও, তাহলে দিচ্ছি ভালো ব্যান্ডউইডথ। ট্রানজিট প্রোভাইডারেরও অবস্থা পোয়াবারো। আমি গ্রাহক হিসেবে পয়সা দিচ্ছি এক মেগাবিট/সেকেন্ড স্পীডের। 'ভিডিও স্ট্রীমিং' হলেই কমে যাচ্ছে গতি ৩০০ কিলোবিট/সেকেন্ডে। বিপদে পড়লো কে? গ্রাহক। আবার ভিপিএন দিয়ে গেলে স্পীড পাওয়া যায় আগের মতো। কে দোষী? গ্রাহক? ইন্টারনেট মানে আমি যা গতি কিনেছি সেটা দিয়ে কি করি সেটা দেখার বিষয় নয় প্রোভাইডারদের। অথচ, সেখানেও নাক গলাচ্ছে ক্যারিয়াররা। সার্ভিসকে রেগুলেট করতে বলেছে কে আপনাদের? আজ একে ফ্রী রাইড, কালকে ওকে পয়সার রাইড - পুরোটাই বৈষম্যমূলক। যতো ভালো কাজের গল্প দিক না তারা।
কাল ফেসবুকে সুন্দরভাবে উত্তর দিয়েছেন একজন - 'যেদিন তাদের মতো কিছু মানুষকে ফ্রী নেট এর আওতায় আনতে পারবেন সেদিন আপনার কথা শুনব,তার আগে নয়।' তুখোড় জবাব। ভালো লেগেছে উত্তরটা। সত্যিই তো! ফ্রী'র কাছে 'নেট নিউট্রালিটি' মানে 'বৈষম্য' টিকবে কিভাবে? 'বিনি পয়সা'র আবেদনই আলাদা। ওই 'চা পান' করার মতো। সেটা অন্যকে মেরে হলেও। টেলিকম রেগুলেটর অথবা 'প্রতিযোগিতা' রেগুলেটরের কাছে এধরনের 'অপ্রতিযোগিতাসুলভ' আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় একেবারে। এ নিয়ে লিখেছিলাম বেশ কয়েকবার। মনে করুন, পেঁয়াজ আমদানী করেন পাঁচটা ব্যবস্যায়িক প্রতিষ্ঠান। আমাদের মতো দেশে। তাদের মধ্যে গোপন 'আঁতাত' রয়েছে কতো দামে বাজারে ছাড়া হবে। এটাকে বলে 'কার্টেলাইজেশন'। আমি হলে তাই করতাম। নিজেদের মধ্যে মারামারি করার মানে হয় কোন? শুরু হলো নিয়ম ভাঙ্গাভাঙ্গি। বাজারে পাঁচটা আমদানিকারকের মধ্যে থাকলো না আর 'প্রতিযোগিতা'। সবাই বিক্রি করছে এক দামে। প্রতারিত হলো ভোক্তারা। আসল দামের কাছেই পৌঁছাতে পারলো না তারা।
ধরুন, কাল আপনি নিজেই আমদানী করতে চাইলেন ওই একই পেঁয়াজ। ধরা যাক তর্কের খাতিরে - অনুমতিপত্রও যোগাড় করলেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। বাকি পাঁচটা কোম্পানীর 'অপ্রচ্ছন্ন' হুমকি সত্বেও। তবে, খুচরা বাজারে ঢোকার আগে সতর্কতার সাথে বাজার যাচাই করে নিজের লাভের মার্জিন কমিয়ে আনলেন ১৫ শতাংশে। বাজারে বর্তমানে যারা আনছেন তাদের মার্জিন প্রায় শতভাগ। আপনি বাজারে ঢোকার সাথে সাথে অন্যেরা দাম কমিয়ে নিয়ে এলো আপনার থেকে আরো বিশ শতাংশে। মানে, পাঁচ শতাংশ ভর্তুকিতে বিক্রি করছেন তারা। কতদিন টিকবেন আপনি? দুমাস? তিন মাস? এক সময় 'নিশ্চিহ্ন' হয়ে যাবেন আপনি। আমাদের গর্ব 'মাইক্রো ইলেক্ট্রনিকস' আজ কোথায়? দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি? গ্লোবালাইজেশন? উহু। মনে হয় না।
উন্নতবিশ্বে সেকারণে বাজার তদারকি করার জন্য রয়েছে আলাদা কমিশন। আমাদেরও শুরু হয়েছে মাত্র। বহুদূর যেতে হবে তাদের। বাঘের মতো ভয় পায় 'ফেডারেল ট্রেড কমিশন'কে যুক্তরাষ্ট্রে। সবাই। 'গ্রাহকস্বার্থ' নিয়ে গুগল করে দেখবেন নাকি একটু? অস্ট্রেলিয়াতে থাকা আপনার যেকোন বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করুন একবার। এই 'অস্ট্রেলিয়ান কম্পিটিশন এণ্ড কনজ্যুমার কমিশন'কে নিয়েই। সামান্য ফোন কল (এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে কল গেলে কতো চার্জ করবে সেটাও দেখভাল করে তারা) থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবস্যায়িক 'অসদাচারণ' নজর এড়ায় না তাদের।
না পেতে পেতে মন ছোট গেছে আমাদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী প্রতিষ্ঠান 'এটিএণ্ডটি'কে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো তাদের আদালত। ছোট ছোট কোম্পানী যাতে কিছু ব্যবসা করে খেতে পারে। বিলিয়ন ডলার কোম্পানীর 'লবিষ্ট'রা বসে ছিলো বলে মনে করেন? টেলিফোন এক্সচেঞ্জের তারগুলোকে আলাদাভাবে ভাড়া দিতে বাধ্য করা হয়েছিল 'লোকাল লুপ আনবাণ্ডলিংয়ের আওতায়। আরো ঘটনা আছে হাজারো। আপনার ব্যবসায় কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার, অন্যের পেটে লাথি মেরে নয়। আর সেকারণে মাইক্রোসফটকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় প্রতিবছর অ্যান্টি-ট্রাস্ট মামলায়। ব্যবসা করেন ভালো কথা, অন্যকে 'আন্ডারকাট' করে নয়। প্রতিটা ব্যবসার একটা খরচ আছে। 'জিরো রেটিং' হচ্ছে সেই নীতির বাইরে।
সোস্যাল নেটওয়ার্ক নিয়ে কথা বলি বরং। ফেসবুক ছাড়া আরো অনেক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে এই এক কাতারে। বাংলাদেশী 'সোস্যাল নেটওয়ার্ক'ই আছে বেশ কয়েকটা। তাদের দোষ কোথায় বলুন? এখন হয়তোবা বলবেন, ওদেরকেও নিয়ে আসেন এই 'জিরো ইন্টারনেট'য়ে। কোন অপারেটরই পারবে না ওই 'পাঁচ ছয়'টা সোস্যাল নেটওয়ার্ককে তাদের ওপর দিয়ে 'রাইড' দিতে। আমিও পারতাম না নিজে অপারেটর হলে। এভরিথিং হ্যাজ আ কস্ট। আপনি যান না কাল কোন এক অপারেটরে। 'জিরো রেটিং'য়ের আবদার নিয়ে। আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য। দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসেনি তারা। আমরা আশা করি না সেটা।
নেটওয়ার্ক তৈরির খরচ, স্পেকট্রামের দাম, গ্রাম পর্যন্ত এই পাইপকে টেনে নেবার খরচ। কেউ না কেউ দিচ্ছে সেই খরচ। অন্য কোন খাত থেকে 'ক্রস-সাবসিডাইজ' করা হচ্ছে বলেই আজ সেটা 'জিরো ইন্টারনেট'। 'সিনথেটিক ইন্টারনেট' বলেন অনেকে। সরকার বা রেগুলেটর 'কাউকে' 'কাউকে' বিনি পয়সার 'রাইড', আর অন্যকে পয়সার রাইড, সেটা বৈষম্যমূলক। সেটা যতো বড়ো বিলিয়ন ডলারের কোম্পানী হোক না কেন। দরকার হলে কমান দাম, সব কিছুর জন্য। আর 'জিরো রেটিং'য়ের কারণে পয়সা দিয়ে ব্যবহারকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা সেটা দেখবে কে? ওই কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্সটা কি আছে অপারেটর থেকে?
মনে আছে মাঝরাতের ফ্রী কল করার মহোত্সবের কথা? মাঝরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ফ্রী'তে কথা বলা? হেভেনলি! বাইরের দেশগুলোতে ওই 'আনলিমিটেড নাইটস এণ্ড উইকএন্ডস' খেয়ে এসে খারাপ লাগার কথা না বাংলাদেশে। ছাত্রছাত্রীরা যাচ্ছে গোল্লায় - এ ছুতোয় বন্ধ হয়ে গেল ব্যাপারটা। ছাত্রছাত্রীরা কথা বলতো তখনো, বলে এখনো। আর স্কাইপ আর ভাইবারের যুগে সেটা বন্ধ হবে না কখনো। আমার কথা অন্য যায়গায়। ওই 'ফ্রী' মহোত্সবের সময় দরকারী কোন কল যেতো না কোথাও। হাজার টাকা দিলেও না। জীবনরক্ষাকারী কল তো কোন ছার! আমি তো আর 'ফ্রী' চাইনি। পয়সা দিয়েই চেয়েছিলাম কল করতে। অপারেটরগণ বরং ভুল করেছিলেন 'নেটওয়ার্ক ডাইমেনশনিং' করতে। এতো কল হবে সেটা যে প্রেডিকশন করেনি তারা - তা নয়।
অন্য ব্যবসার মতো রাতের দিকে নেটওয়ার্ক খালি পড়ে থাকে বলে এই গল্প। আইএসপিদের হ্যাপি আওয়ারের মতো। পড়ে আছে তো খালি ব্যান্ডউইডথ, ব্যবহার করুক না সবাই। তবে, নট অ্যাট দ্য কস্ট অফ আদার্স। যখন আমি পয়সা দিয়েই চাচ্ছি সার্ভিস। 'এনলাইটেন' রেগুলেটর আছে যে দেশে, ভুলেও তাদের নাম দেখবেন না নিউজ মিডিয়াতে। কে কিভাবে ব্যবসা করবে তার সবকিছু লেখা আছে ওয়েবসাইটে। ফলে গ্রাহকও জানে সে কি পাবে, আর সার্ভিস প্রোভাইডাররাও জানেন 'কতো টাকায়' তাকে 'কি দিতে' হবে। একদম 'লিখিত' ভাবে। স্বচ্ছতার চুড়ান্ত। ঝামেলা লাগে যখন লেখা থাকে না কিছু। লেখা থাকলে সবাই খুশি। অপারেটরদের 'কমপ্ল্যায়েন্স কস্ট' বাড়লেও ঝামেলা কম। তারাও চায় সেটাই। যেমন, সামরিক বাহিনীতে লেখা থাকে সবকিছু। যুদ্ধের সময় প্রতিনিয়ত 'ক্ল্যারিফিকেশন' কে দেবে শুনি? শত্রু কি যুদ্ধবিরতি দিয়ে বসে থাকবে ওই 'ক্ল্যারিফিকেশন' নেবার জন্য? জীবন নিয়ে কাজ কারবার, না লিখলে চলে? আর সেকারণে লিখেছি বেশি। রেগুলেটরকে দেখা যায় তখনই, যখন ভুল করে কেউ। সংশোধন দিয়ে 'হাইবারনেশনে' চলে যায় সে। বাকিটা দেখে বাজার, গ্রাহক আর মিডিয়া।
'নেট নিউট্রালিটি' কিন্ত নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে টানাটানি চলছে অনেক বছর ধরে। মোদ্দা কথা, 'বৈষম্য' করা যাবে না। ইন্টারনেট ট্রাফিক নিয়ে। এখানে সবাই সমান। ধনী আর দরিদ্র, এক কাতারে। দূরত্ব বা সার্ভিসের প্রকার দেখে দামের ওঠানামা? একেবারে নো, নো। 'ভয়েস ওভার আইপি' প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এক চার্জ, আর ফেসবুকিংয়ে আরেক চার্জ। অথবা ওয়েব ব্রাউজিংয়ে ভিন্ন চার্জ। শুনেছেন কখনো? শুনবেন এখন। 'সনাতন' টেলিকম জ্ঞানের মানুষ থেকে। ঢাকা থেকে ঢাকা ভয়েস কল করলে এক রেট, সিলেটে আরেক রেট, বিদেশে বড় বড় রেট। এটাই দেখে এসেছেন তারা সারাজীবন। 'ইন্টারনেট' তাদের হাতে পড়লে যা হয় আর কি। জন্ম থেকে দেখছি - ইন্টারনেট হচ্ছে 'কোথায় সার্ভার আছে' সেটা বিবেচ্য নয়, সংযোগ পাবেন আপনি। পেতে বাধ্য। ঢাকার সার্ভার আর লণ্ডনের সার্ভার - পয়সা এক। আর সেটার জন্য দাম - ওই ফ্ল্যাট রেট। কেউ কি বলেছিল ইউটিউবে গেলে প্রতি মেগাবিটস এক পয়সা আর ফেসবুকে গেলে দশ পয়সা? আজ শুনছি, কোথাও পয়সা লাগবে আর কোথাও কোথাও না। তবে, 'বিনে পয়সা'র আকর্ষণ কে আটকাবে?
কয়েক বছর আগে সরকার আমাকে পাঠিয়েছিলো 'আইক্যান'এর সবচেয়ে বড় মিটিংটাতে। সান-ফ্রান্সিসকোতে হয়েছিল সেটা। সিলিকন ভ্যালীতে। বলতে বাধা নেই - আমাদের এই গরীব দেশটা আমার পেছনে যতো 'ইনভেস্ট' করেছে এই 'ইন্টারনেট' বোঝার জন্য, সেটা নেহায়েত কম নয়। একটা হতাশা লক্ষ করেছিলাম ওই 'ইন্টারনেট নিজ হাতে তৈরি করা' মানুষগুলোর মধ্যে। সাধারণ টেলিকমের মতো ইন্টারনেটকে 'রেগুলেট' করার চেষ্টা ব্যথিত করছিলো সবাইকে। আমার ধারণা, আমাদের মতো দেশগুলোতে সরকারী টেলিকম কোম্পানী থেকে মানুষ এসে বসেছে রেগুলেটরের চেয়ারে। মানুষ হিসেবে সবাই অসাধারণ তারা, তবে সনাতন 'টেলিকম' ধারণা থেকে ইন্টারনেটকে 'রেগুলেট' করতে গিয়ে মূলনীতি থেকে সরে আসছে তারা।
আজ 'আপলোড' 'ডাউনলোড' রেশিও নিয়ে খোঁচাখুচি, কাল ওই আইপি'র 'পোর্ট' বন্ধ, পরশু, একটা লিংক বন্ধ করতে গিয়ে পুরো সাইট বন্ধ। একবার তো বসিয়ে দিলো 'ওয়ার্ডপ্রেসে'র মতো বিশ্বের এক নম্বর ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম। সে আরেক ঘটনা। মাঝরাতেই তৈরি করলাম নতুন নির্দেশনা। ঝুঁকি নিয়ে। এই 'ওভার রেগুলেশন'য়ে ইন্টারনেট পরিণত হচ্ছে একটা 'ডিষ্টরটেড' ভার্সনে। আমাদের মতো দেশগুলোতে। আর সেটার ফলশ্রুতিতে ইন্টারনেটকে ঘিরে যাদের রুজি রোজগার - ফ্রীল্যান্সিং, কল সেন্টার মানে 'কনট্যাক্ট সেন্টার', নেটওয়ার্ক মনিটরিং, টেলিমেডিসিন, আউটসোর্সিং - এই ব্যবসাগুলো পড়ে বিপদে। ওঁরা যে কতো কষ্ট করে একেকটা কাজ যোগাড় করে আনেন দেশের বাইরে থেকে, সেগুলো উবে যায় নিমিষেই - কিছু 'অসতর্ক' সিদ্ধান্তের কারণে।
হঠাত্ দেখলেন বড় 'আপলোড' বন্ধ হয়ে গেছে আপনাকে না জানিয়ে। আর যে বিদেশী কোম্পানীটা কাজ দিয়েছিলো - তারাও খুঁজতে থাকে নতুন দেশ। সময়ের কাজ সময়ে না দিতে পারলে কেই বা কাজ দেয় আর? বদনাম হতে থাকে দেশের। যারা ভাবেন শুধু ফেসবুকে 'লাইক' দিয়ে টাকা কামানো যায় তাদের যেতে হবে আরো অনেক দূর। নীতিনির্ধারকদের দেশকে 'মুখে মুখে' ভালোবাসলেই হবে না, ভালোবাসতে হবে এখানকার মানুষগুলোকে। বের করে দিতে হবে 'নতুন' 'নতুন' রুজি রোজগারের পথ। আর এই ইন্টারনেট হচ্ছে সেই বিশাল 'ইকুয়ালাইজার'। ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে 'এটা ওটা করা যাবে না' না বলে উদ্যোক্তা হবার পথ দেখালে সুবিধা বেশি।
ইন্টারনেট নিয়ে যুদ্ধ আজকের নয়। এই ২০১২ সালে সামনাসামনি অবস্থান নেয় ইউনাইটেড নেশনের 'ইন্টারন্যাশন্যাল টেলিকম্যুনিকেশন ইউনিয়ন' আর ইন্টারনেট পুরোধা 'আইক্যান'। টেলিকম্যুনিকেশন ইউনিয়ন হঠাত্ করে ধারণা করতে শুরু করেন - সনাতন টেলিকমের মতো ইন্টারনেটকেও 'গভার্নেস' করতে দিতে হবে নিজ নিজ দেশকে। কোন দেশে কি কনটেন্ট ঢুকবে সেটা দেখবে দেশগুলো। এই তথাকথিত 'রেগুলেট' করাকে নিয়ে বিশাল 'যুদ্ধ' শুরু হয় দেশগুলোর মধ্যে। শেষমেষ কিছুটা বিপদেই পড়ে 'আইটিইউ'। বুঝতেই পারছেন - চীন, আরব বিশ্ব আর রাশিয়া অবস্থান নেয় এই রেগুলেশনের পক্ষে। ইন্টারনেটের সুফল পাওয়া 'গণতান্ত্রিক' দেশগুলোর প্রবল আপত্তির মুখে এই 'ইন্টারনেট গভার্নেস' ঠাই পায় শুধু কাগজেই।
'এফসিসি' মানে ফেডারেল কম্যুনিকেশন শেষ মেষ ইতি টানতে বলেছেন এই 'জিরো রেটিং' গল্পে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জড়িত হয়েছেন নিজে। দেখুন ভিডিও। নরওয়ে ২০০৯এর 'নেট নিউট্রালিটি' গাইডলাইন দিয়ে আটকেছে অনেক আগে। তাদের কথা, আর যাই হোক, গ্রাহকদের মধ্যে তৈরি করা যাবে না বৈষম্য। চিলি তো অনেক সাহসী। ল্যাটিন আমেরিকাতে বন্ধ করেছে সবার আগে। বাকিরা প্রথম প্রথম সন্মতি দিলেও পিছিয়ে যাচ্ছে দেশের ভেতরে ইনপুট পেয়ে। মনে আছে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া আর লিথুনিয়ার কথা? ই-গভার্ণেসে সেরা দেশগুলো আটকেছে ব্যাপারটা। মাল্টা, জাপান? ইট'স আ নো নো। ভারতে? 'ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকম' মন্ত্রণালয় লিগ্যাল নোটিস পেয়েছে অনেক আগে। পাবলিক কনসাল্টেশন চলছে 'টেলিকম রেগুলেটরী অথরিটি অফ ইন্ডিয়া' মানে রেগুলেটরের সাইটে।
এবছরের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত পাবলিক কনসাল্টেশনে দশ লাখের বেশি পিটিশন পেয়েছে এই রেগুলেটর। এই দশ লাখ পিটিশন এসেছে 'কীপ ইন্টারনেট ফ্রী' ট্যাগলাইন নিয়ে। ভারতের মতো দেশে এই 'নেট নিউট্রালিটি' নিয়ে সাধারণ মানুষের 'রেসপন্স' চোখে পড়ার মতো। ওদেশের ই-কমার্স জায়ান্ট ফ্লিপকার্ট জনরোষে পড়ার ঠিক আগ মূহুর্তে বের হয়ে গেছে এয়ারটেলের তথাকথিত 'জিরো ইন্টারনেট' থেকে। দেশের নীতিনির্ধারণীতে বসে থাকা মানুষগুলো ইন্টারনেটকে 'আগের মতো রাখার' ব্যপারে মানুষের আবেগকে মূল্য দিতে সাড়া দিয়েছে তাদের মন্ত্রিসভা। আশস্ত করেছেন মানুষকে - এমন কিছু করা হবে না যাতে ইন্টারনেট ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
পৃথিবীটা 'দেয়া নেয়া'র। মানতে হবে এই দেয়া নেয়ার ব্যাপারটাকে। সবাই মানে। সেখানে দরকার খানিকটা 'কম্প্রমাইজে'র। তবে আমরা যাচ্ছি হেরে। তবে সেটার শুরুতে গল্প নিয়ে আসি একটা। অনেকেই জানেন জিনিসটা। অপু আর বাস অপারেটরদের গল্প! অরবিন্দ রবি সুলেখার লেখা। হৃদয় ছুয়েছে অনেকের মতো আমারও।
রূপপুর বাসস্ট্যান্ড নিয়ে নতুন গল্প দেবার কিছু নেই। শহর থেকে এক ঘণ্টা দূরে একটা গ্রামের পাশ দিয়ে বড় রাস্তা গেলে যা হয় আর কি। বড় রাস্তার পাশ দিয়ে ভেংগে যাওয়া মাটির সরু রাস্তা, ধুলো আর কাদা দিয়ে ভর্তি থাকে বছরের বেশিরভাগ সময়ে।
Last updated
Was this helpful?