৪.৫. দরকার কি ইকোসিস্টেমের?
দরকার কি এইসব ইন্টারনেট 'ইকোসিষ্টেমে'র? একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখতে পারবেন এগুলো একটা আরেকটার ওপর - পুরোপুরি 'ইন্টার-ডিপেণডেণ্ট'। একটা ছাড়া আরেকটা অচল। অথচ, এই ইকোসিষ্টেমের প্রতিটা জিনিষ নিয়ে কাজ করে সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট। সত্যিই তাই। কার সাথে কোনটার কি সম্পর্ক সেটা না জানলেই বিপদ। ইন্টারনেটের ট্রান্সমিশন মানে হাই-স্পীড নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। সার্ভিসগুলো কার? সেটা তো আসলে সবার। অনলাইন ক্লাস নিয়ে মাথাব্যথা হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। 'জেনারেল পারপাজ টেকনোলজি' হিসেবে সবকিছুই দরকার সব মন্ত্রণালয়ের। 'হেল্থকেয়ার' নিয়ে ইন্টারনেটের সুবিধা নিচ্ছে পাশের দেশ ভারত। হাজার মানুষ প্লেন ভরে আসছে ওই দেশে 'হেল্থকেয়ার' ট্রিপে। প্রাথমিক 'ডায়াগনস্টিকস' হচ্ছে ইন্টারনেটের ওপর দিয়ে। থাইল্যান্ড আর সিংগাপুর তো শুরু করেছে অনেক আগেই।
স্বাস্থ্য আর চিকিত্সা নিয়ে কাজ করবে সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়। 'অ্যাপ্লিকেশন' নিয়ে কাজ করছে আইসিটি মন্ত্রণালয় অনেক আগে থেকে। তবে কেউ জানে না কার করতে হবে - কতোটুকু অংশ। নাকি আবার 'ডুপ্লিকেশন অফ ইফোর্ট' হচ্ছে বার বার? বিটিআরসিতে থাকার সময় দেখেছি এধরনের কাজ - করছে সবাই। সবার দরকার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক, পয়সা ঢালছে কিন্তু সবাই। গরীব দেশে এটা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। এমনিতেই ফান্ডিংয়ের সমস্যা, সেখানে পয়সা যাচ্ছে নতুন নতুন জায়গায় - না জানার কারণে। ডোনার এজেন্সিরা সরকারের এই 'সমন্বয়হীনতা' ব্যাপারটা জেনেও দেনার ধার বাড়াচ্ছেন দিনে দিনে।
ইন্টারনেট বা ব্রডব্যান্ড যাই বলেন সেটা যে শুধু হাই-স্পীড নেটওয়ার্ক নয় - সেটা থেকে বের হতে এই 'ইকোসিষ্টেম' ব্যবস্থা। সার্ভিস আর অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করার আগে কথা বলে নিতে হবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে - জিনিসগুলো তাদের নেটওয়ার্ক নিতে পারবে কি না? টিএণ্ডটি'র যুগে 'টেলিফোন মডেল' থেকে বের হয়ে আসতে হবে আগে। একটা ফোনের জন্য একটা লাইন। আরেকটা ফোন লাগাতে চাইলে আরেকটা লাইন - আর ফ্যাক্স চাইলে আরেকটা। ওইটা ছিলো পুরনো টেলিযোগাযোগের 'ওয়ালড গার্ডেন'[পুরোনো নেটওয়ার্ক মানে এই গল্প। একজনের সার্ভিস আরেকজনের ওপর দিয়ে দেবার কথা চিন্তাই করতো না মানুষ।] সমস্যা, সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা রিসোর্স। এখনকার যুগে লাইন আসবে একটা, ওইটার ওপর যা চাইবেন তাই করবেন। আবার সার্ভিস আর অ্যাপ্লিকেশন কিন্তু শুধুমাত্র আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি নয়, এটা সবার। শিক্ষা আর হেল্থকেয়ার অ্যাপ্লিকেশন কেন তৈরি করবেন তারা? ব্যবহারকারী মন্ত্রণালয় জানেন না - কিন্তু তার অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছেন আরেকজন। 'ইন-কম্পাটিবিলিটি'র শুরু ওখানেই। সনাতন 'পুশ' মানে 'খাইয়ে দেয়া'র মডেল থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের। পয়সা ঢালো 'সাপ্লাই সাইডে', মানে দাম কমাও ইন্টারনেটের - ওতেই হবে সব - সেটা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে আমাদের।
মানি, পুরনো শেখাটাকে 'আন-লার্ন' করা কষ্টের। সেটাকে মেনেই চিন্তা করতে হবে নতুন 'কনসেপ্চুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক', বড় আকারে - সবাইকে নিয়ে। ব্যবহারকারীদের নিয়ে। টাকা দেয় তো তারাই। তাদের জন্যই তো সবকিছু। চারটা কম্পোনেণ্টকে আলাদা করে মাইলস্টোনে ভাগ করলেই 'ফোকাস' এরিয়াগুলো বোঝা যাবে সরকারের দিক থেকে। ইকোসিষ্টেমের প্রতিটা কম্পোনেণ্টকে আলাদা করে সেটার জন্য সরকারের কোন কোন এজেন্সি কাজ করবে সেটা বের করতে হবে আগে। সেটার 'ফীডব্যাক' লুপ যাবে সরকারী বিভিন্ন প্রোগ্রামগুলোতে। সেটাকে ঘিরে ঘোরাতে হবে সরকারের সম্পর্কিত পলিসিগুলোকে। শুধুমাত্র ব্রডব্যান্ড নীতিমালা নিয়ে কাজ করতে গেলে পয়সা, সময় আর 'ফোকাস' নষ্ট হবে আরো বেশি। আমাদের মতো গরীব দেশের জন্য সেটা হয়ে যাবে বড় ধরনের বিলাসিতা। এখনকার 'ব্রডব্যান্ড প্লান' আগের মতো নেই আর। এটা শুরু হয় দেশের 'দর্শন' নিয়ে। দেশ কি চায়, সেটা বের করতে হয় আগে। টেকনোলজি বাদ, দেশের 'প্রায়োরিটি' বের করতে হয় খুটে খুটে। উদাহরণ দেখবেন নাকি একটা? 'কানেক্টিং আমেরিকা' বলে ওদের ন্যাশন্যাল ব্রডব্যান্ড প্ল্যানটা দেখলে পরিষ্কার হবে সবার। দেখুন তাদের দর্শনগুলো - প্রথম কয়েক লাইনে। সবকিছু আছে ওতে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা, চিকিত্সা ব্যবস্থা, সরকারের কাজের জবাবদিহিতা, এনার্জি খাত, মানুষের নিরাপত্তা, আরো অনেক কিছু - কোন কিছু বাদ রাখে নি তারা। এক্সিকিউটিভ সামারিটা না পড়লে ব্যাপারটা না ধরতে পারার সম্ভাবনা বেশি। একটা দেশ কি চায়, সেটাই এনেছে এই প্ল্যানে। বিশাল ক্যানভাস।
'বিল্ডিং ব্রডব্যান্ড' বইটাতে আমাদের মতো দেশগুলো কি ধরনের ভুল করতে পারে সেগুলোর বেশ কিছু ধারনা দিয়েছেন আগেভাগেই। ব্রডব্যান্ড মানে ইন্টারনেটের মতো প্রোডাক্টের ডিমান্ড তৈরি করার মতো 'ব্যাপারটা'র ধারনা না থাকাতে পুরো ইনভেস্টমেন্ট চলে যায় 'সাপ্লাই' সাইডে। মানে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি হলেই খুশি। কিভাবে বাড়াতে হবে ব্যবহারকারীদের সংখ্যা, তৈরি করতে হবে নতুন নতুন সার্ভিস, নতুন গ্রাহকবান্ধব অ্যাপ্লিকেশন - সেটা পলিসিতে না থাকাতে পুরো কাজটাই যায় ভেস্তে। 'ইকোনোমি অফ স্কেল' - ব্যবহারকারী বাড়লে কমবে দাম, আর দাম কমলে আসবে নতুন নতুন সার্ভিস, নতুন ইনভেস্টমেন্ট। ইকোসিষ্টেমের তুখোড় সাইকেল হচ্ছে জিনিসটা। কম্পোনেণ্টগুলোর মধ্যে 'ইন্টার-ডিপেনডেন্সি' থাকাতে পুরো জিনিসটাকে ফেলতে হবে বড় ক্যানভাসে। ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি 'হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ', তাহলেই কাজ করবে পুরো ইকোসিষ্টেম। কম্পোনেণ্টগুলোর একটার ওপর আরেকটার নির্ভরশীলতা কাজ করে অনেকদিক থেকে। হাই-স্পীড ট্রান্সমিশনে ইনভেস্টমেন্ট আসা মানে 'কোয়ালিটি অফ সার্ভিস' বাড়বে আমাদের দরকারী সব সার্ভিসগুলোতে। আর সেটা বাড়িয়ে দেবে 'ব্যান্ডউইডধ ইন্টেসিভ' অ্যাপ্লিকেশন তৈরির মাত্রা। যতো বেশি অ্যাপ্লিকেশন, ততো বেশি টানবে নতুন নতুন গ্রাহকদের। নতুন গ্রাহকেরা চাপ তৈরি করবে নেটওয়ার্ক এক্সপ্যানশনের কাজে। ফলে বাড়বে ইন্টারনেট আর ব্রডব্যান্ডের ওপর নতুন ইনভেস্টমেন্ট। পুরো পৃথিবী বসে আছে পয়সা নিয়ে। ব্যবসাবান্ধব নীতিমালার জন্য বসে আছে কোম্পানীগুলো।
নতুন সার্ভিস আসা মানে নতুন কনটেন্ট তৈরির হিড়িক। কনটেন্ট তৈরি করছেন ব্যবহারকারীরা নিজেই। ইন্টারনেটের শুরুতে ডাউনলোডই ছিলো বেশি। আজ - পাল্টে গেছে দাবার গুটি। অ্যাপ্লিকেশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে গুগল আর ফেসবুকের মতো কোম্পানীগুলো। হাজার হাজার গিগাবাইটের 'ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট' আসছে আপনার আমার দিক থেকে। আমার আপনার ভিডিও, ছবি, ব্লগ পোস্ট দিয়ে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট। ষাট হাজার ছবি আছে আমারই, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। আগে কনটেন্ট তৈরি করতো মিডিয়া কোম্পানীগুলো। এখন সেটা চলে এসেছে গ্রাহকদের হাতে। ফলে, দরকার হচ্ছে হাই-স্পীড নেটওয়ার্ক - ব্যবহারকারীর দোরগোড়ায়।
যে হারে ডাটার ভলিউম বাড়ছে সেখানে হাই-স্পীড টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির কথা হচ্ছে মাত্র একদম প্রথম ধাপে। এর পাশাপাশি ইন্টারনেটকে রেগুলেটরী ভাষায় 'ইউনিভারসালাইজ' মানে 'সবার জন্য' করার ব্যপারে যে নীতিমালাগুলোকে পরিবর্তন আনতে হবে সেটার কথা বলা দরকার আগে। নতুন নতুন সার্ভিস নিয়ে আসতে প্রোভাইডারকে উদ্বুদ্ধ করা - সেটা করতে হবে বর্তমান নীতিমালা সহজ করার মাধ্যমে। আর দরকারী অ্যাপ্লিকেশন - মানে মানুষের কষ্ট কমানোর সরকারী অ্যাপ্লিকেশন - 'ওয়ান স্টপ শপে'র মতো, এক পোর্টাল সব সার্ভিস। ই-সেবাকে সহজ করার যতো নীতিমালা দরকার সেটা না করলে সুবিধা পাবে না জনগণ। মানুষকে ছলে বলে কৌশলে কিভাবে অনলাইনে আনা যায় সেটার হিসেব কষতে হবে নীতিনির্ধারণীদের। ফাইনান্সিয়াল অথবা মোবাইল 'ইনক্লুসিভনেস' মানে শহরের মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং খেটে খাওয়া মানুষের দরকার এই ই-সেবা। তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি পয়সা খরচ করতে হয় ঘাটে ঘাটে।
ইন্টারনেট ব্যাপারটাকে ইকোসিষ্টেম হিসেবে দেখলে সবচেয়ে বেশি লাভ সরকারের। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জানবে তাদের প্রতিটা বিভাগের কাজ কি? কার সাথে কার কাজ সম্পর্কিত, আর 'ইন্টার-ডিপেনডেন্সী' মানে হচ্ছে সবাই মিলে কাজ করা। আর সেটার তদারকি করবে প্রধানমন্ত্রী'র অফিসের ভেতরে থাকা 'ব্রডব্যান্ড কমিশন'। সেই কমিশনের কাজ হচ্ছে সবার কাজ তদারকি করা, কারণ - ক্যানভাসটা তো তার কাছে। অন্যদের কাজ 'এন্ড টু এন্ড' হচ্ছে কিনা সেটা না দেখলে পুরো প্রজেক্টই মাটি। সরকারের 'পুশ' পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে না বলেই এই 'পুল' পদ্ধতি। খুঁজে খুঁজে তৈরি করতে হবে সরকারের 'এনাবলিং' সিষ্টেমগুলো। 'পুল' পদ্ধতি মানে হচ্ছে গিয়ে ব্রডব্যান্ডের ডিমান্ড বাড়ানোর কারুকার্য। বাড়াতে হবে ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা। 'ডিজিটাল লিটারেসী' বলেন অনেকে। আর সেটার জন্য তৈরি করতে হবে যথোপযুক্ত আইনি ফ্রেমওয়ার্ক।
Last updated
Was this helpful?